শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৩ পূর্বাহ্ন
বাংলাদেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক উত্তাল সময়ে যখন অসহযোগিতা, বিভাজন ও অস্থিরতা দেশকে বারবার পিছিয়ে দিচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে দায়িত্ব নিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। বয়সের ভার, সীমাহীন প্রতিকূলতা ও বহুমুখী চাপ সত্ত্বেও তিনি এক অচেনা পথে হাঁটার চ্যালেঞ্জ নিলেন। কেউ তাকে ক্ষমতার লোভী বলেছে, কেউ ষড়যন্ত্রের কারিগর, কিন্তু সময়ের সঙ্গে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে: জাতীয় সংকটমূহুর্তে তার ভূমিকা রাজনৈতিক হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি ছিল রাষ্ট্ররক্ষার দায়িত্ববোধ।
বিচারব্যবস্থা সংস্কারের সাহসিকতা
বছরের পর বছর বিতর্কিত মামলা, তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার সংস্কার যা অতীতের কোনো সরকারই পূর্ণভাবে করতে পারেনি, সেখানে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়। বহু বাধা, রাজনৈতিক চাপ ও সমালোচনা সত্ত্বেও বড় বড় মামলার তদন্ত এগিয়েছে। দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত জাতীয় ক্ষত যেমন পিলখানা ট্র্যাজেডি নতুন করে তদন্তের আলো দেখেছে। এটি নিঃসন্দেহে বিচারব্যবস্থায় স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার সাহসী উদ্যোগ।
অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কঠিন পথচলা
দুর্বল ব্যাংকিং খাত, খেলাপি ঋণ, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন সব মিলিয়ে অর্থনীতি যখন খাদে, তখন খাতগুলো পুনর্গঠনের উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মহলেও। বিদেশে ঘুরে ঘুরে দেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার, বিনিয়োগ টানা, আর্থিক আস্থা ফেরানো এই সবগুলোয় তার কূটনৈতিক দক্ষতা ও দৃঢ়তা স্পষ্ট।
আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবেলায় অদম্য অবস্থান
বিরাট সব বিদেশি চাপ, দফায় দফায় নিষেধাজ্ঞা, হুমকি সবকিছুকে উপেক্ষা করে জাতীয় স্বার্থরক্ষার বার্তা দিয়েছেন দৃঢ়ভাবে। অনেকেই ভেবেছিল বাংলাদেশ নতি স্বীকার করবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা
অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক দোলাচল, প্রাকৃতিক দুর্যোগ সব মিলিয়ে যখন রাষ্ট্রযন্ত্র বিপর্যস্ত, তখন প্রশাসনকে পুনর্বিন্যাস, নিরাপত্তা জোরদার ও সাধারণ মানুষের আস্থা ফেরানোর উদ্যোগ স্পষ্টভাবে দেখা গেছে। অনেক অপপ্রচার, বিক্ষোভ, প্রতিরোধ সত্ত্বেও দেশের স্থিতিশীলতা ছিল প্রধান অগ্রাধিকার।
মেধা ও সততার প্রতি অবমূল্যায়নের আক্ষেপ
কিন্তু এই পথ মোটেও ছিল না মসৃণ। দেশে মেধাবী, সৎ, দেশপ্রেমিক ব্যক্তিদের জন্য যে পরিবেশ থাকা উচিত তা এখনও পুরোপুরি তৈরি হয়নি। এমনকি যারা দেশের ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের কাজে হাত লাগাতে চেয়েছেন, তারাও বাধার দেয়ালে বারবার ধাক্কা খেয়েছেন।
অনেকেই তাই মনে করেন,
বাংলাদেশে যোগ্য মানুষ রাজনীতিতে আসতে ভয় পায় কারণ আমরা প্রাপ্য সম্মান দিতে জানি না।একজন ৮৫ বছর বয়সী মানুষের রাষ্ট্ররক্ষার দায়িত্ব নেওয়া এ এক বিরল দৃষ্টান্ত বয়স, স্বাস্থ্য, আন্তর্জাতিক ব্যস্ততা সবকিছু উপেক্ষা করে দেশের ক্রান্তিলগ্নে এগিয়ে আসা সহজ সিদ্ধান্ত ছিল না। কেউ কেউ তার প্রতি অসহযোগিতা করেছে, কেউ ব্যক্তিগত আক্রমণ, আবার কেউ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার তীর ছুঁড়েছে।
তবুও তিনি থেমে যাননি
মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার স্বপ্ন পরিবর্তনের জন্য যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে, যারা গুলি-বোমার সামনে দাঁড়িয়েছে—তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই: মানুষ যেন সম্মানের সঙ্গে নিরাপদে বাঁচতে পারে। মৌলিক অধিকার, ন্যায়বিচার, সমতা এই স্বপ্নটাই ছিল পুরো আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু।
এই জাতির ভবিষ্যৎ?
সময়ই বলে দেবে সামনে যে সরকার আসবে তারা এই গতিকে ধরে রাখতে পারবে কি না। কিন্তু একটি সত্য ইতিহাসের পাতায় রয়ে যাবে বাংলাদেশ এক কঠিন সময় এক সাহসী, নীতিমান ও বিচক্ষণ মানুষকে পেয়েছিল।
শেষ কথা
যারা পরিবর্তনকে আটকে রাখতে চেয়েছে, যারা প্রতিটি ভালো উদ্যোগে বাধা দিয়েছে, তাদের ইতিহাস ক্ষমা করবে না। কিন্তু যারা দেশকে ভালোবাসে, তারা স্মরণ করবে একজন নোবেলজয়ী ৮৫ বছর বয়সী মানুষ, বাংলাদেশের সংকটে সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। তার নীতিবোধ, সাহস এবং দায়িত্ববোধ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।
